গত বছরের মার্চ মাসের ২১ তারিখ আমি ক্লিনিক্যাল ফেলো হিসেবে icddr,b তে জয়েন করি। আমার ফেলোশিপের শেষ দিন ছিল মার্চের ১৬ তারিখ। ইউকে’র ভিসা পেয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেলোশিপ ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
ইন্টার্নশিপ করতে যেয়ে দেখেছিলাম যে বই এর সাথে ওয়ার্ডের কাজের কোন মিল নাই। বইয়ে লেখা এক কথা, বাস্তবে করা হচ্ছে আরেকটা। বইয়ে লেখা এক এন্টিবায়োটিক এর নাম, দেওয়া হচ্ছে আরেকটা। তখন ভাবতাম আসলেই বোধহয় ব্যাপারটা এরকম। আইসিডিডিআরবিতে এসে শিখলাম কিভাবে গাইডলাইন, প্রটোকল মেনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায় এবং কিভাবে তা নিয়মিত আপডেট করা হয়।
এখানে যেসকল রোগের চিকিৎসা করা হয় সকল রোগের চিকিৎসার জন্যে একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। কোন ডাক্তার চাইলেই তার ইচ্ছামত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে পারবেন না। কেউ চাইলেই মনগড়া ডোজ ব্যবহার করতে পারবে না। ইচ্ছামত এন্টিবায়োটিক সুইচ করা সম্ভব না। ইচ্ছামত টেস্ট করাতে পারবেন না। কেউ এন্টিবায়োটিক চেঞ্জ করতে চাইলে সেটার কারণ ব্যাখ্যা করে তারপর পরিবর্তন করতে হয়।
নিয়মিত এখানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়৷ আপনার মনে হলো যে নিউমোনিয়াতে এখন অমুক এন্টিবায়োটিক ভাল কাজ করে- এজন্যে আপনি ওটা দেওয়া শুরু করলেন- এসব এখানে হয়না। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর মাধ্যমে সেটা প্রমাণিত হতে হবে- তারপরই পরিবর্তন আসবে ম্যানেজমেন্টে।
কিভাবে আরো ভাল সেবা দেওয়া যায়- The search for better service- এটা যেন শেষ হবার নয়। জয়েন করার পর থেকে প্রতি মাসেই দেখছি রোস্টার, হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে নতুন নতুন পরিবর্তন। কিছুদিন পর পর ট্রায়াল এন্ড এরর এর মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় আরো ভাল সার্ভিস দেওয়ার।
Clinical Fellow দেরকে ভালোভাবে ট্রেইন করার জন্যে প্রতি সপ্তাহে আছে একটা করে ক্লাস৷ এবং একটা করে কেস প্রেজেন্টেশন, যেখানে উপস্থিত থাকেন সকল ডাক্তার, এবং থাকেন ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ডা. চৌধুরী আলী কাওসার স্যার। প্রতি ৬ মাস পরপর জুনিয়র ডাক্তারদের ইভালুয়েট করা হয়, এবং সেই ভিত্তিতে তাদের কন্ট্রাক্ট রিনিউ করা হয়।
Basic Life Support নিয়ে প্রচুর ক্লাস করেছি, ভিডিও দেখেছি। সারাজীবন পড়ে এসেছি যে এইটা টিম ইফোর্ট। ডাক্তার- নার্স-ওয়ার্ডবয় সবার ইনভলভমেন্ট লাগবে। কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি এটা কোথাও দেখিনি। আইসিডিডিআরবিতে এসে দেখেছি কিভাবে সত্যিকার অর্থে Basic Life Support দিতে হয়। CPR শুরু করার জন্যে এখানে কেউ ডাক্তারের অপেক্ষায় থাকেনা, ডাক্তার অর্ডার করার আগেই এট্রপিন এড্রেনালিন রেডি হয়ে যায়। দিনের ২৪ ঘন্টা- সপ্তাহে ৭ দিন- বছরে ৩৬৫ দিন- সিনিয়ররা অন-কল থাকেন। যখনই ফোন করা হয়- তারা আছেন।
টিম ইফোর্ট কী জিনিস তার ছোটখাট উদাহরণ দেখা যায় ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে।
সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন এর একজন রোগী আসার সাথে সাথে মনে হয় ১০ সেকেন্ডও লাগেনা IV Fluid শুরু হয়ে যায়। কোত্থেকে কে কোথায় ছুটে আসবে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। এমন একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি যেখানকার ডাক্তার, নার্স, গার্ড সবাই মনপ্রাণ দিয়ে শুধু একটা জিনিস চায়- কিভাবে আরো ভাল সার্ভিস দেয়া যায়।
নার্সিং অফিসার প্রতিদিন সকালে ডাক্তারদেরকে একটা মেইল পাঠান- গতদিন মোট রোগী কতজন, কতজন ডিসচার্জড, কতজন ভর্তি, কতজন কোভিড সাসপেক্টেড এ গিয়েছে, কতজন রেফার হয়েছে, রেফার হওয়া রোগীরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন এবং আইসিউতে থাকা রোগীদের ডিটেইলস। যেকোন ডাক্তারের যেকোন জিজ্ঞাসা থাকলে তারা আবার সেটা জানতে চান। Executive Director স্যার আবার মেইল দেখে বিভিন্ন ব্যাপারে ইনকোয়ারি করেন – কেন এই টেস্ট করা হলো? আমরা কি আরেকটু ভালভাবে ম্যানেজ করতে পারতাম কিনা।
বাংলাদেশের একমাত্র হাসপাতাল বোধহয় এটা, যেখানে রেফার করা রোগীদেরকে হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনা খরচে এম্বুলেন্স এর মাধ্যমে হায়ার সেন্টারে পৌঁছে দেয়া হয়, তার সাথে হাসপাতালের পক্ষ থেকে একজন এটেন্ডেন্ট দেওয়া হয় যার কাজ রোগীকে রেফার কৃত হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসা । যে ডাক্তার রোগীকে রেফার করেছেন, তাকে রেফার পরবর্তী ৪৮ ঘন্টা রোগীর আপডেট রাখতে হয়, এবং হসপিটাল ডিরেক্টরকে জানাতে হয়।
এই এক বছরে যে কয়েকজন রোগী মারা গিয়েছেন, প্রতিটা মৃত্যুর পর ইনকোয়ারি হয়েছে, হয়েছে ডেথ কেস প্রেজেন্টেশন, পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে হাসপাতালের নিয়ম কানুন, প্রটোকল।মিনিমাম লোকবল- মিনিমাম রিসোর্সকে ব্যবহার করে কিভাবে ম্যাক্সিমাম এফিসিয়েন্সি দেখানো যায় তার অন্যতম সেরা উদাহরণ হতে পারে আমাদের এই হাসপাতালটি।
আইসিডিডি আরবিতে প্রচুর অপ্রাপ্তি ছিল।
প্রথম এবং সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি হচ্ছে এটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল না। অনেক রোগী আসে এখানে, কিন্তু সবাইকে সম্পূর্ণ চিকিৎসা দেয়ার মত সুযোগ থাকেনা। হয়ত মাল্টিডিসিপ্লিনারি না বলেই কোয়ালিটি মেইনটেইন করা সম্ভব।
অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কোনদিন আইসিডিডি আরবি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল করবে- এমন প্রত্যাশা রাখি।
আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আইসিডিডিআরবির প্রতি। আইসিডিডিআরবির সিনিয়রদের কাছ থেকে যা যা দেখেছি এবং শিখেছি, তার কিয়দাংশও যদি আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবো। যদি কোনদিন যোগ্যতা হয়, আমি আবার ফিরতে চাই এই হাসপাতালে।
Tags: