আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারাঃ এপ্রিল ১৬, ২০২০

গেল নভেম্বরে  তিন বছর হলো আমাদের প্রেম এর। তিনটা বছরে একটা বারের জন্যেও ঝগড়া করিনাই, বকা দেইনাই। সেই তুলনায় গত ১ মাস খারাপ গেছে। কতবার ঝগড়া করলাম, কান্না করলো ও। কতবার বকলাম, গাল ফুলায়ে রাখলো। খারাপ লাগতেছে খুব। চলে যাওয়ার আগে এতবার না বকলেও পারতাম।
শেষ দিনগুলাতে অনেক বার রান্না করে খাওয়াইছে মেয়েটা আমাকে। একদিন খিচুড়ি আর মুরগি ভূনা খেতে চেয়েছিলাম। ফ্রীজ থেকে মুরগি টেনে বের করতে পারেনাই বেচারা। এত্তো মন খারাপ করছিল! তখনও জানিনা যে আর বেশিদিন দেখা হবেনা।

আব্বা কথা বলা বন্ধ করে দিছেন অনেকদিন। বলছিলেন, \”ফাইনাল কথা বলো, তুমি কুমিল্লা আসবা কিনা।\” বলছিলাম \”আব্বা কেমনে আসবো?\” তারপর থেকে আর ফোন দেন নাই। আমি ফোন দিলে ধরতেন না। মাঝেমধ্যে ধরতেন। ধরে কান্না করতেন। মা রোজা রাখেন অনেকদিন। আমাকে প্রতি বেলা ডিউটিতে যাওয়ার সময় ফোন করতেন, গ্লাভস, মাস্ক, পিপিই পড়ি যেন। ডিউটি থেকে ফেরত আসার সময় ফোন করতেন। হাত মুখ ধুয়ে যেন ঢুকি রুমে। চা খেতে দোকানে না যাই যেন।
একমাত্র ছেলে। ভাইবোন নাই। আব্বা আম্মা সারাদিন আমারে নিয়ে ভাবে। কত চেষ্টা করলো কুমিল্লা নিয়ে যাওয়ার। যাইতে ইচ্ছাই করলোনা।

কার্ডিওলোজিস্ট হতে চাইতাম। ওয়ার্ডে স্যারেরা কেউ কিছু শিখায় না বলে খুব আক্ষেপ ছিল। ওপারে মঈন স্যারের নিশ্চয়ই ব্যস্ততা নাই কোন, স্যারের থেকে শিখে নিবোনে সবকিছু। 
স্যারকে প্রথম দেখা হলে কি বলবো?
\”স্যার, Acid Base Disorder পড়তেছিলাম ওইদিন। ইউটিউবে, অনলাইনে প্রচুর লেখা এই টপিক নিয়ে। এত কঠিন। এত ভেজাল। অথচ ফার্স্ট ইয়ারে নাসিম স্যার পড়াইছিলেন এগুলা সব।\” অধ্যাপক ডাঃ নাসিমুল হক স্যার এর কথা বললাম।  আমার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ জীবনের সবচাইতে প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে একজন। স্যার বায়োকেমিস্ট্রিতে অনার্স দিতে চেয়েছিলেন। দিলেন না কেন কে জানে, নাকি রিটেনে আটকায়ে গেলাম আল্লাহ ভালো জানেন!

এইভাবে মরে যাবো ভাবিনাই। খুব ইচ্ছা ছিল ইংল্যান্ড যাবো প্লাব দিয়ে। ট্রেনিং ডিগ্রী শেষ করে ফেরত আসবো বুড়া বউ আর এক হালি ছানাপোনা নিয়ে।
বছর বছর নতুন আইফোন, একটা বিএমডাব্লিউ গাড়ি, আর ছোট্ট একটা ঘর। ভূতকে বলতাম, \” আমাদের ঘরের প্রতিটা কোণায় কোণায় তোমার আমার ভালোবাসার চিহ্ন থাকবে। \”  \”চুপ, খাটাশ \”, ও বলতো। আমাকে প্রায়ই খাটাশ ডাকতো ও, আর মাঝেমধ্যে ভোটকা।
ভালো থাকিস বুড়ি। কান্না করিস না। লক্ষী না তুই।♥
আমার বইখাতা গুলো তোকে দিয়ে গেলাম। যত্ন করে রাখিস, যেমনটা যত্ন করে রান্না করতি আমার জন্যে।

আমার আব্বা আম্মার খোজ নিস । ছেলেমেয়ে নাই ত আর, কষ্ট পাবে অনেক। দেখা করিস দেশ ঠান্ডা হয়ে গেলে। আমার মাকে বলিস তুই আমাকে রান্না করে দিতি মাঝেমধ্যে । মা আদর করবে তোকে অনেক।
শেষ কিছুদিনে অনেক বকছি তোকে। রাগ করে থাকিস না। মন খারাপ করিস না আমার জন্যে। আমি যেন কান্না করতে না দেখি তোকে।

আম্মা, আম্মাগো, তুমি চাইছিলা আমি ডাক্তার হই। হইছিলাম মা। যে কয়জন রোগীকে চিকিতসা দিছি, কারোর সাথে কোনদিন খারাপ ব্যবহার করিনাই। কেউ ডাকলে রোগীর কাছে যেতে এক মিনিট দেরী করিনাই। তোমার ছেলে অনেক মানুষের দোয়া নিয়ে গেছে দুনিয়া থেকে। বুক ফুলায়ে চলবা সারাজীবন। আব্বার কথা শুনলে হয়তো এত আগে চলে যাওয়া লাগতো না। কে জানে! আল্লাহ চাইছে যেহেতু, আগেই যাই। একদিন ত সবার যাইতে হবে। নানার কথা মনে পড়ে মা। ফার্স্ট প্রফের দুইদিন আগে মারা গেছিলেন। দেখতে যাইনাই। নানুকে কানতে দিওনা। বইলো যে তোমার নাতী মানুষের জন্যে জীবন দিছে।

আব্বা, তানহার জন্যে একটা হ্যান্ডব্যাগ কিনে রাখছিলাম। আমার বিছানার মাথার কাছের শেলফে আছে। এইটা দিও ওকে। আর ওই রুমে টেবিলের এর ড্রয়ারে ৫ হাজার টাকা আছে। এখান থেকে ২ হাজার ভূতকে দিও। ওকে একটা জামা কিনে দিতে চাইছিলাম। আমার ফোনে দেখবা Azad Golden Line নামে একটা নাম্বার সেভ করা, উনার নাম্বারে ১ হাজার টাকা বিকাশ করে দিও। বাকি ২ হাজার রাইখো তোমার কাছে। ও ভাল কথা, নির্ঝরের জন্যে একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি কিনবা। বইলো যে আমি কিনে দিছি। টুনু, তাসকিন আর সিয়ামের জন্যে চকলেট।


In the end, the whole of life becomes an act of letting go. But what always hurts the most is not taking a moment to say goodbye.
ডাক আসার আগেই বিদায় নিলাম সবার থেকে। মনটা খারাপ লাগতেছে।
ভাল থাকবেন সবাই।

https://youtu.be/kUj-_1Z-8ME

Tags:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top