সে অনেককাল বর্তমানের কথা

একটা গল্প লিখার শখ ছিল আমার। সে অনেককাল আগের কথা। ফার্স্ট ইয়ার। মাথায় ছোট্ট চুল, ঢোলা প্যান্ট, কাধে একটা ব্যাগ- সেই আমি।

বাসায় থাকতাম। আমি আর আম্মা। আব্বা আসতো কয়দিন পরপর।১৫ দিন, একমাস। একবার আব্বা আসলো। বায়োকেমিস্ট্রি থার্ড টার্ম ছিল পরদিন।পরীক্ষার সময় আব্বা আসলে আমি খুব বিরক্ত হইতাম। আব্বা পড়তে দিতোনা।খেলা দেখতে বসাইতো, জীবন ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা বলতো।আব্বা মিষ্টি নিয়ে আসতো আসার সময়-একগাদা মিষ্টি, সাথে দধি। বাসায় খুব বাজার হত দুইদিন। আমি মাছ তেমন পছন্দ করতাম না। আম্মা মাছ তেমন কিনতো না। আব্বা রাজ্যের মাছ কিনে আনতো- পাবদা ছিল কমন। খাওয়ার পর বাধ্যতামূলক তিনজন পাশাপাশি শুইতে হইতো। আম্মা আব্বার পায়ে তেল দিয়ে দিত। মাঝে মাঝে খাওয়ার পর আব্বা চা খাইতে চাইতো। আম্মা চিতকার পাড়তো \”প্যাচাল কইরনা, এখন চা বানাইতে পারমু না।\” বইলাই চা বানাইতে যাইতো, বানায়ে আনতো। চা খাইতাম সবাই মিলা। আমি ঘুমায় যাইতাম, সেই ছোট্টবেলা থেকে আম্মার গায়ের গন্ধ পেলে আমার ঘুম চলে আসতো। ক্যাডেট কলেজ নামক জায়গাটাতে যখন আমার ঘুম আসতো না, আমি খুব মনে করতে চাইতাম আম্মার গায়ের গন্ধটা কেমন ছিল। বড় হচ্ছি যে ব্যাপারটা আসলে খুব চোখে পড়ে। আব্বা-আম্মা এখন বাসার অন্য পিচ্চিগুলারে নিয়ে ব্যস্ত। বাসায় তিনজন একসাথে খুব কমই থাকা হয়। বাসায় গেলে কেউ নোসিলা আনে না, মাইলো আনে না। যে কয়দিন থাকি, আব্বার সাথে কিঞ্চিতই দেখা হয়।

১০ ডিসেম্বর একটু পরে। আমার ২৩তম জন্মদিন। জন্মের পর প্রথম জন্মদিন যেখানে আম্মা পাশে নাই।আমি ফরিদপুরে, আম্মা কুমিল্লাতে। আম্মার সাথে খুব উদ্ভট কিছু কথা বলতাম আমি। আম্মাকে খাটের উপর বসায়ে আমি আম্মার কোলে মাথা রাখতাম। রেখে আম্মাকে হাতে জড়ায়ে ধরে বলতাম \”আম্মা, আম্মাগো, তোমার গায়ে গন্ধ।\” আম্মা কি বুঝতো কেজানে। আমি বলতাম আম্মাদের শরীরের গন্ধের কথা। যে গন্ধে সন্তানের ঘুম আসতো।

ছোটবেলার কথা বেশ মনে পড়ে। আমি পেস্ট্রি পছন্দ করতাম। আব্বার খুবি অপছন্দ এইসব- কেক, বেলুন আর মোম। কখনো আমার জন্মদিন করা হতনা। ক্লাস ওয়ানে পড়ি যখন, সেবার প্রথম আমার জন্মদিন করা হল। নানা অনেক আয়োজন করলেন। মনে আছে সেদিন মেট্রো  বেকারি থেকে ২০টা পেটিসও অর্ডার করা হয়েছিল।মানুষের স্মৃতি না,  খুবি অদ্ভুত একটা জিনিস। জরুরি অনেক কথা মনে থাকেনা, কিন্তু এইযে এই্বস হাবিজাবি মেট্রো বেকারি, ২০টা পেটিস, খুশবো স্টোর্স,  ১৮ ফেব্রুয়ারি , চন্দনা ম্যামের হিস্টোলোজি ক্লাসে গল ব্লাডারের স্লাইডকে ভুলে লাং বলে ফেলা, চোখের উপর এসে পরা চুল সরানো এইগুলা মনে থাকে। আবার সব দরকারী কথা যে ভুলে যাওয়া হয় এইরকমও না। ২০টা পেটিস অর্ডার করেছিলেন নানা। আমার চেহারা নানার মত। নানার হাপানি ছিল, আমারও আছে। ফার্স্ট প্রফের দুইদিন আগে নানা মারা গেলেন। আমি দেখতে গেলাম না। আম্মা সারারাত কান্না করলেন। আব্বার সাথে নানার রাগ ছিল। সেই ছোটকাল থেকে দেখতাম আব্বা নানাকে পছন্দ করতেন না। নানার কথা উঠলেই আব্বা বাজে বক্তেন, আম্মা কান্না করতেন। পরদিন দুপুরে আব্বা ফোন দিল নাকি আমি দিয়েছিলাম খেয়াল নাই, তবে সেই সময়টাতে আব্বা কান্না করতেছিল- এটা স্পষ্ট মনে আছে। এত বছর যে কথা না বলে ছিল, যাবার বেলায় সেই দূরত্ব কোথায় চলে গিয়েছিল যেন! নানাকে দেখতে যাইতেন আব্বা প্রত্যেকদিন। হুইল চেয়ার কেনা হইছিল, কেনা হইছিল একটা কলিং বেলও। নানা অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন, অক্সিজেন লাগত। অথচ কোনদিন আমার ইচ্ছাও করতোনা যেয়ে দেখে আসতে। এখন মাঝেমাঝে খুব মনে পড়ে। নানার হাত ধরে ধর্মসাগরপাড় যাওয়ার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে সেই ছোটকালে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে নানা আসতো বাসায়, আমাকে নেয়ার জন্যে। আমি যাইতে চাইতাম। আব্বা আম্মার বোধহয় ঝগড়া হইতো এইটা নিয়ে, আমি যাব নাকি যাবোনা। যাকগে। একবার ঈদে নানা আমার জন্যে জামাকাপড় কিনে আনলো। আম্মা এমনিতে কাপড়চোপড় আনলে লুকায়ে রাখতো, কিন্তু সেবার আব্বা দেখে ফেলসিল কিনা। আম্মাকে খুব কাদতে দেখছিলাম। এই মহিলাটা আমাকে ভালবাসতো অনেক। আই মিন, ভালবাসে। গতবছর এই সময়ে যখন আমি হোস্টেলে উঠার জন্যে খুব উথালপাথাল করতেসিলাম, আম্মা তখন একদিন চোখে পানি নিয়ে আমাকে বলসিল \”আব্বা, তুমি হোস্টেলে থাকো সমস্যা নাই, বাসাটা থাকুক, তুমি সপ্তায় একদিন বাসায় আইসো।\” বাসা আমার কখনোই খুব একটা প্রিয় জায়গা ছিল না। এখন যখন খুব কফি খাইতে ইচ্ছা করে আর নিজের বানায়ে খাইতে হয়;গভীর রাতে খিচূড়ি খাইতে ইচ্ছা করলে পরদিন মোহনা হোটেলে যেয়ে খেয়ে আসতে হয় তখন আম্মার কথা মনে হয়। বাসা থেকে যখনি বের হইতাম ২০০ টাকা দিত আম্মা, দিনে যতবার বের হই ততবার। কোনদিন ভাবি নাই টাকাটা কোত্থেকে আসে, এখন ২০০ টাকায় দিনের খাওয়া প্লাস হাবিজাবি খরচ রিক্সা ভাড়া দেয়া লাগে। আম্মার কথা মনে পড়ে।

এই গানটা শুনে দেখতে পারেন চাইলে।

https://www.youtube.com/watch?v=6hxInLPIQ6c

Tags:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top