অটোতে করে ওয়ার্ড থেকে ফিরছিলাম।
মেডিসিন ওয়ার্ড।
ওয়ার্ড শুরু হল রবিবারে।
ওয়ার্ড শুরুর আগেরদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে সামনের মানুষটাকে বলেছিলাম প্রত্যেকদিন অন্তত দুটো করে হিস্ট্রি নিবো। সকালের ওয়ার্ড শেষে কলেজে এসে লাইব্রেরীতে বসেই শেষ করবো লেকচার গোছানোর কাজ।
আজকে সন্ধ্যার ওয়ার্ড শেষে আর হিস্ট্রি নিতে মন চাইলো না।
কোনমতে পার্সেন্টেজ দিয়েই দৌড়ে নেমে গিয়ে অটোতে উঠলাম।
অটোওয়ালা মামার কপাল খারাপ।
পুরো অটোতে এক আমিই যাত্রী।
পুরো রাস্তাজুড়ে কোথাও কারেন্ট ছিল না।
সে কি অন্ধকার!
গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আনমনে ভাবছিলাম।
হেডফোনে ফুল ভলিউমে অর্থহীন বাজছিল।
পকেটে ২১৫ টাকা ছিল।
২টা ১০০ টাকা, একটা দশ টাকা আর একটা ৫ টাকার নোট।
হেডফোন বের করার জন্য বাম পকেটে হাত দিয়ে দেখি আরো কিছু আছে। পাখির ছবিওয়ালা ২ টাকার নোট।
মোটমাট ২২৩ টাকা।
চারদিক অন্ধকার, অদ্ভুত রকমের বাতাস।
সব মিলিয়ে খুব ভাল্লাগছিল।
ঠিক করলাম পকেট খালি হওয়ার আগ পর্যন্ত অটোতে করে ঘুরবো।
বাজারে নেমেই আবার ফিরতি অটোতে উঠলাম।
এবারে পেসেঞ্জার উঠে ঝামেলা বাধায়ে দিলো।
ভাই! ও ভাই!
আপনের কানে এইটা কি?
জ্বি?
এইটা কি আপনের কানে?
হেডফোন।
এইটা দিয়া কি করে?
গান শুনে।
কয় টেকা দাম?
………
……….
……….
পুরান বাসস্ট্যান্ড এসে নেমে গেলাম।
আবার অটোতে উঠার ইচ্ছা ছিল না একদমই।
মন চাইছিল কানে হেডফোন লাগিয়ে চরকমলাপুর ব্রীজের উপর দিয়ে হাটতে।
যাবো কি যাবো না সেটার হিসেব কষছিলাম।এমন সময়:
মামা যাইবেন?
-কই যাবেন?
আপনি যেহানে যাইতে চান ওইহানে যামু।
-দাড়ান এক মিনিট।
ততক্ষনে চা খাওয়ার নেশা উঠে গেছে।
চা খাবো, রিক্সা চড়বো।
চা, রিক্সা, আকাশ, গান।
আহ!
কিছু না ভেবেই পাশের চা দোকানে গেলাম।
-মামা, এক কাপ দুধ চা। চিনি বেশি।
লন।
-আচ্ছা মামা, আমি চায়ের কাপটা কালকে সকালে ফেরত দিয়া যাই?
ক্যা?
-এমনেই। রিক্সা চড়তে চড়তে চা খাবো।
মামা বিধ্বস্ত চোখে তাকায়ে রইলো।
উনার আগুনমত চেহারা দেখে আমি মুখ খুললাম।
-আপনে আমার ফোন নাম্বার রাখেন। আর এই ১০০ টাকা রাখেন।
মামা আপনের চা খাওয়া লাগতো না। ফুটেন।
সার্জারি ওয়ার্ড যখন করি, তখন নিজেকে বুঝিয়েছিলাম সার্জারিই আমার সাবজেক্ট।
ব্যস্ততা, পারফেকশন, ফোকাস।
আহ!
অথচ মেডিসিনে এসে মনে হচ্ছে এটার জন্যেই তো আমার এতদিনের অপেক্ষা।
কিন্তু জানো, ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না।
আমি চাইতাম পড়াতে।
এখনো তাই চাই।
পড়াবো।
একদল উতসুক ছেলেপেলে ঘিরে রাখবে আমাকে।
আমি তাদের দিয়ে উদ্ভট সব খেলায় মাতবো।
এই প্রশ্নের উত্তর যে দিতে পারবে আমার বাম পকেটে যা আছে সব তার।
কিংবা লেকচার ক্লাস বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিতে যাওয়া।
কিংবা মন খারাপ করা সকালে গায়ক ছেলেটার কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে নেয়া।
চাওয়ালা মামার বয়ানে চ্যাপ্টা হয়ে চা খাওয়ার নেশা চলে গেল। একটা আইসক্রিম নিয়ে রিক্সায় উঠে গেলাম।
এই, ফয়সাল!
পরচিত কন্ঠস্বর। তাকিয়ে দেখি গোলাপী।
কই যাও?
-কলেজ যাচ্ছি।
আমি আসি?
….
….
ফরিদপুরের আকাশে সন্ধ্যারাতে বিমান দেখা যায়না।
খুব খারাপ লাগতো প্রথমদিকে।
আজকে যখন রিক্সা করে হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে পরিচর্যা হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসছিলাম, তখন খেয়াল করলাম ফরিদপুরের আকাশেও লাইটজ্বলা বিমান দেখা যায়।
একদা একজন বলিয়াছিল, প্রফের পর গোলাপীকে খুজিয়া আনিয়া দিবে।
তেত্রিশ বছর কাটলো।
কেউ কথা রাখে না।
[ পুনশ্চ ১:
মেডিসিন ওয়ার্ড পরবর্তী স্ট্যাটাস :১
পুনশ্চ ২:
মেডিসিন ওয়ার্ডের স্যারেরা এত্তো স্মার্ট কেন!
পুনশ্চ ৩:
এমনিতে আব্বু আসলে তারা ভরা রাতে লিখি।আজকে আব্বু আসেনি।তাও লিখছি।মন আসলেই অনেক ভালো।
🙂
]