কিছু বিষাদ হোক পাখি : ৮

ফরিদপুর।
৩০ আগস্ট, ২০১৫।
রাত পৌনে চারটা।
শুয়ে ছিলাম।
শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম।

It\’s a quarter after one,
I\’m a little drunk
and I need you now.

Lady antebellum এর গান।
Need you now.
গানটা মোবাইলে ছিল আগে থেকেই। এক বন্ধু দিয়েছিল।কিন্তু শোনা হয়নি কখনো সেভাবে। শুনে থাকলেও সেকথা মনে পড়ছেনা। সেদিন রাতে মনে ধরলো গানটা। রাত তখন আড়াইটা কি তিনটা হবে। রেল স্টেশনে বসে ছিলাম আমরা।
আমি, রাজন আর সৌমিক।
আমরা তিনজন।
পরদিন আইটেম ছিল সকালে। পড়বো বলে হোস্টেলে গিয়েছিলাম।
হোস্টেলে থাকার কত্তো সুবিধা! যখন তখন বের হওয়া যায়।যখন তখন ঘুমিয়ে নেয়া যায়।
পড়তে গিয়েছিলাম হোস্টেলে।
পড়িনি যে, তা না।
পড়েছি।
এক ঘন্টা হবে।
আমি, সৌমিত্র,সৌমিক আর রাজন। গ্রুপ স্টাডির অভ্যাস ছিল না কখনোই। সেদিন একসাথে পড়ার পর খেয়াল হল গ্রুপ স্টাডি জিনিসটা খারাপ না। বিশেষত ওয়ার্ডের জন্য।
একটামত বাজে তখন। রাজন, সৌমিকের সাথে চা খেতে বেরিয়েছিলাম।খন্দকারের সামনের মামার টঙে কফি খেয়ে হেটে হেটে হোস্টেলে ফিরছিলাম। আরেকটু হাটি,আরেকটু হাটি করতে করতে ঠাই হয়েছিল রেল স্টেশনে।
আমি, রাজন আর সৌমিক।
আমরা ছিলাম তিনজন।
মাঝরাতে হাটতে বের হওয়ার এই স্বপ্নটা আমার বহুদিনের।
বৃষ্টি, জোছনা আর রাত জাগা যখন থেকে ভালো লাগতে শুরু করলো, তখন থেকেই। ইন্টারে পড়তাম তখন।
বাবা মায়ের আদর্শ সন্তান ছিলাম।
সকালে আম্মার সাথে করে কলেজে যাই ।ক্লাস করি। দুপুরে আম্মার সাথে করে কলেজ থেকে ফিরে আসি।
এভাবেই চলছিল।
১২ সালের শুরুর দিককার কথা।
হঠাত করেই রাত জাগার অভ্যেস হল।
তারপর থেকে নিজেকে খুব বিশাল কিছু মনে হতে থাকলো।
\”আমি রাতে ঘুমাই না।হুম।\”

প্ল্যাটফর্মের চেয়ারে বসে জগত-জীবন-নারী-প্রফ-পোস্টগ্র‍্যাজুয়েশন বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হচ্ছিল।
সৌমিক গান ছাড়লো।
এমনিতে আমার ইংরেজি শোনা হয়না।
বাংলা শুনি। বাংলা খাই। বাংলা ছাড়ি।
সৌমিক কিছু ইংরেজি শোনাল।  অনেকগুলা গানই শুনেছিলাম। এখন শুধু এক্টার কথাই মনে আছে। এইযে এইটা।

ভোরবেলাটায় কলেজ গেটে বসে বসে ভোর হওয়া দেখলাম আমরা।
সেলফি তোলা হল বেশ কয়েকটা।

\"image\"

এরপর স্টেশন রোডে তেলের সাগরে ভাজা পরোটা আর ডাইল-ভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে রুমে গিয়েছিলাম সেদিন।

\"image\"

সৌমিকের নতুন কেনা S6 Edge দিয়ে তোলা সেলফি।
ভীষন রকমের সুন্দর ফোন।
কার্ভ স্ক্রীন।
সৌমিককে প্যারা দেয়ার জন্যে আমি বলি ট্যাপ খাওয়া ফোন।

মাঝে অনেকদিন আমার ফোন-ল্যাপটপ এগুলার উপর কোন আসক্তি ছিল না।হঠাত করেই আবার শুরু হল জিনিসটা।
চোখে শুধু আইফোন দেখি।
স্কুলে পড়ার সময় এই জিনিসটা খুব ছিল আমার।
ফোন আসক্তি।
বাসায় ইন্টারনেট ছিল না তখন। পত্রিকাই ছিল ভরসা।
প্রত্যেকদিন সক্কালবেলা পেপার খুলে দেখতাম আজকে নতুন কি ফোন এর এড দিয়েছে।
আমরা ছিলাম ২ জন।
আমি আর তারেক।
ফোন নিয়ে গবেষনা করতাম।
তারেক অনেক উচ্চমানের গবেষক ছিল যদিও।
একেকটা নতুন ফোন আসতো আর আমি বলতাম, বড় হইলে এইটা কিনবো।
এমন করতে করতে একদিন সত্যিই বড় হয়ে গেলাম আমি।

সোয়া চারটা বাজল।
এখনো Lady Antebellum শুনছি।

And I said I wouldn\’t call
but I\’m a little drunk
and I need you now.
And I don\’t know how I can do without.
I just need you now.


আপুটার কথা মনে পড়ছে।
ওইযে হিজাব করা আপুটা।
শাহেদ ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক ছিল যে আপুটার, উনার কথা বলছি।
ইন্টার্ন করতে এসে মারা গেলেন ভাইয়া।
ভাইয়ার সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিল না।
নাম জানতাম, শাহেদ ভাই। বাড়ি চিটাগাং। তুখোড় ছাত্র। ফাইনাল প্রফে গাইনি- সার্জারি দুইটাতেই হাইয়েস্ট পেয়েছিলেন।
ভাইয়ার সাথে তেমন কথা হত না কখনোই।
শেষ কথা কবে হয়েছিল মনে পড়ে না। কিন্তু কথাগুলো খুব মনে পড়ে।

বায়োতে অনার্স পাইসিস শুনলাম।
…..
সাবাস বেটা। ভালমত পড়িস।
…….

জলজ্যান্ত রক্তমাংসের এক্টা মানুষ হঠাত করেই পৃথিবী থেকে নাই হয়ে গেলেন।
আচ্ছা, আপুর যখন ভাইয়াকে দেখতে মন চাইবে তখন কি করবেন আপু? কখনো কি আগের মত করে পাশে পেতে মন চাইবে না?
হয়তো কোনদিন স্বপ্নে এসে ধরা দিবেন ভাইয়া।
আমার অনেক সময় এরকম হয়। স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারি যে আমি স্বপ্ন দেখছি। তখন খুব করে চাই ঘুমটা না ভেংগে যাক। কিন্তু ঠিক তখনই ঘুম ভেংগে যায়।

আপুর যদি এরকম হয়?
ভাইয়াকে স্বপ্ন দেখছেন। কথা বলছেন ভাইয়ার সাথে হয়ত।
কিন্তু বুঝতে পারছেন যে রক্তমাংসের শাহেদের হাত দুটো আর কখনোই ধরা হবেনা।
ঘুম ভেংগে গেলেই নিজেকে ইন্টার্ন হোস্টেলে দেখতে পাবেন।

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলা?
…….
জানো, আমার না খুব কষ্ট হয়। খেতে বসলে তোমার কথা মনে পড়ে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে তোমার কথা মনে পড়ে।
………
শুনো, তুমি কক্ষনো আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ভাল আছি। ঠিকমতখাওয়া দাওয়া করবা। একদম অনিয়ম করবা না। রাতের বেলা অত বেশি চা খাবা না।
…….

বিদায়বেলা হয়ত ভাইয়া রুপাই এর মত করে বলে উঠবেন :

\”মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যাথা লাগে,
দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে।
সিন্দুরখানি পরিও ললাটে- মোরে যদি পড়ে মনে,
রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী- কোণে।
মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাধিও চুল,
আলসে হেলিয়া খোপায় বাধিও মাঠের কলমী ফুল।
যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে- না শুনি আমার বাশী,
বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাংগা হাসি।
চেয়ো মাঠ পানে – গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান;
কান পেতে থেকো, যদি শোন কভু সেথায় আমার গান।
আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া
মোর তরে কেদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া।\”

ঘুম ভাঙতেই আপু হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠবেন আবারো।
রাত বাড়তেই থাকবে।
হাজার বছরের পুরনো সেই রাত।
:\’-)

:\’-)

Tags: ,

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top