আম্মাকে বলেছিলাম, ভাল্লাগেনা।
– কেন ভাল্লাগেনা?
জানিনা, বললাম আমি।
– কেমন লাগে তাহলে?
সেটাও জানিনা, কেমন যেন একটা শূন্য শূন্য ভাব।
আম্মা পাত্তা দেয়নি। আব্বাকে বলার প্রশ্নেই উঠেনা।
আমার এই \’ভাল্লাগেনা\’ রোগের সাক্ষী হয়ে রইলো কাছের কিছু মানুষ। কেউবা স্কুল, আবার কেউবা কলেজের আবার কেউবা এখনকার বন্ধু।
শূন্যতার এই ব্যাপারটাই কখনো কাউকে বুঝাতে পারতাম না আমি, এখনো পারিনা। নিজে কখনো বুঝতাম না আমি কি চাই, কাউকে বুঝাতেও পারতাম না।
মানে খাচ্ছি-দাচ্ছি, কলেজ যাচ্ছি, ক্লাস করছি, ঘুরছি – কিন্তু তারপরেও কেমন যেন লাগতো। বাসায় আসার পরেই শুরু হত ব্যাপারটা। পরদিন সকালেই হয়তো একটা কার্ড ফাইনাল আমার, কিন্তু দেখা গেল রাত দশটা বেজে গেল, বই নিয়ে বসতেই পারলাম না।
একজন জিজ্ঞেস করলো, কি কি পড়সিস?
বললাম, দোস্ত এখনো পড়তে বসি নাই।
সে হয়ত আমাকে টিপিক্যাল স্বার্থপর ভাব নেয়া আতেল ভেবে নিল।
একটা পরীক্ষার রেজাল্ট দিল।
হয়তো ভাল করলাম।
স্যার হয়ত ক্লাসে খুব প্রশংসা করলেন।
মানুষ ভাবলো ওর মত সুখী তো কেউ এই দুনিয়ায় নাই।
অথচ এই ব্যাপারগুলো যে কোন ভালোলাগার জন্ম দেয়না এটা বুঝাতে পারলাম না কাউকে।
\”The opposite of depression is not happiness, it’s vitality অর্থাৎ, ডিপ্রেশন কিংবা বিষণ্ণতার বিপরীত কখনোই আনন্দ নয়, বরং সক্ষমতা। কথাটা বাংলায় হয়তো একটু জটিল শোনাচ্ছে, আরেকটু ভেঙ্গে বলি- আপনি ডিপ্রেসড নন, তার মানে এই না যে, আপনি সারাদিনই খুব ফূর্তিতে আছে, আনন্দে আছেন। বরং আপনি ডিপ্রেসড নন, তার মানে হচ্ছে আপনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠছেন, প্রাত্যহিক কাজ শেষে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাচ্ছেন। সেখানে সহকর্মীদের সাথে কথা বলছেন, বসের সাথে মিটিং করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। দিন শেষে বাসায় এসে আপনার স্বামী কিংবা স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, বাচ্চাদের সাথে খেলছেন। ডিপ্রেশন আপনার এই দৈনন্দিন সক্ষমতাকে শেষ করে দেয়।\”
\”ডিপ্রেসনের একটা কি ফিচার [ Key Feature ] হচ্ছে, শূন্যতা। ডিপ্রেশনে ভুগছেন এমন অনেকেই জানিয়েছেন যে, তারা বুকের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। নিরন্তর শূন্যতা। এই শুন্যতার অনুভুতিটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।\”
ভাবতে পারেন, পুরো এপ্রিল মাসটা জুড়ে আমি সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত শুধু বসে থাকতাম। কখনো কখনো লিখে শূন্যতাটুকু ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতাম।
\”জ্বরে ভুগতে থাকলে জানবেন যে, শরীরের এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক না। আপনি ক্যান্সার আক্রান্ত হলে জানবেন যে এই টিউমার এক ধরনের অস্বাভাবিকতা। অথচ ডিপ্রেশন আক্রান্ত হলে আপনার কখনোই মনে হবে না যে আপনার চিন্তাটা ভুল। কারণ, বস্তুত ঠিক ভুল বলে কিছু নেই। একজন ডিপ্রেসড মানুষ জীবনের যে অর্থহীণতা আবিষ্কার করে জীবন যাপনে অনীহা বোধ করেন, তা কিন্তু ঠিক বা ভুলে মাপার যোগ্য না। যারা ডিপ্রেসড নন, তারা স্রেফ জীবনকে নির্দিষ্ট কিছু ফিল্টারের নিচে ফেলে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যান। যে ফিল্টার আমাদেরকে আশ্বস্ত করে যে বেঁচে থাকাই পরমার্থ এবং জীবনের যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রেই জীবনকে ছুড়ে ফেলা বাদে অন্যান্য যেসব সমাধান আছে, সেগুলির থেকেই আমাদের একটি বেছে নিতে হবে। ডিপ্রেসড মানুষেরা শুধু সে ফিল্টারটা হারিয়ে ফেলেন। জীবন তাদের কাছে এতো অর্থহীন মনে হয়ে যে, তারা প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবেন- তবুও কেনো বেঁচে আছি? ডিপ্রেশন শুরুতে মানুষকে একধরনের দ্বৈত জীবন যাপনের দিকে ঠেলে দেয়। \”
\”বাকি পৃথিবীর সামনে একজন সুস্থ, সামাজিক মানুষের অভিনয়, আর একান্ত নিজের কাছে এমন এক জীবন, যেখানে সবকিছুই অর্থহীন। এই দ্বন্দ্ব, টানা পোড়েনে একসময় দুই জীবনের মধ্যের সেই সেতুটি ধ্বংস হয়ে যায়, আর একজন বিষণ্ণ মানুষ আটকা পড়ে যান তার নিজের আপাত অর্থহীন জীবনে।\”
সবচাইতে হাসি পায় যখন কেউ বলে, তোর কিসের ডিপ্রেশন?
তাইতো, আমার মা আমার সাথে থাকে।হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। পড়ালেখা নিয়েও টেনশন নেই। ফ্যামিলি চালানোর ঝামেলাও নেই। প্রেম-ছ্যাক জনিত জালেও আটকা পড়িনি। তাহলে আমার কেন ভাল্লাগেনা?
\”প্রতিটা মানুষের সংগ্রামই তার নিজস্ব, এবং তার ইউনিক। শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্ট্রাগলই একমাত্র স্ট্রাগল না। একজন মানুষ প্রাচুর্যে বেঁচে আছে, তার অর্থ কখনোই এই না যে সে সুখে আছে, ভালো আছে। হয়তো তার পরিবার কিংবা কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাকে অসুখী করে তুলেছে। কিংবা সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধুমাত্র মস্তিষ্কের রাসায়নিক সামঞ্জস্যের অভাবে সে অসুখী। কারণ যাই হোক, একজন মানুষ ডিপ্রেসড হতে পারে, এবং তার কষ্টটুকু পুরোপুরি সত্যি। \”
এই একাকীত্ব ভাব কাটানোর জন্যে আমি লিখতাম। ব্লগে।
গোলাপী সাদা শাড়ি পরে একজন রোজ আমার কথাগুলো শুনতে আসতো। কখনো তার কাধে মাথা রাখতাম আমি, কখনোবা দুজনেই বটতলায় পা ঝুলিয়ে বসতাম। আমি বলতাম, ও শুনতো। কখনো হেসে কুটিকুটি হত, কখনোবা \”থাক, ওরে মাইরা দিব\” টাইপের সান্ত্বনা।
মানুষজন না এটাকেও \’ঢং\’ হিসেবে দেখে।
\”অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিপ্রেসড একজন মানুষ মূলত একজন মানুষকে চায় যার কাছে সে তার কথাগুলি বলে কিছুটা নির্ভার হতে পারে, এবং অবশ্যই যে মানুষটি জাজমেন্টাল না। আপনি একজন ক্যান্সার রোগীকে কি কখনো বলবেন যে, অন্য কারো জীবন কতো ভালো, কিংবা অন্য কেউ কষ্টে থেকেও কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে? যদি না বলেন, তবে
কেন একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে আপনি এই কথাগুলি বলবেন, যেখানে ডিপ্রেশন
ক্যান্সারের মতোই প্রাণঘাতী একটি অসুখ? কাজেই ডিপ্রেসড মানুষের প্রতি কোনো কথা কিংবা আচরণেই যেন জাজমেন্ট প্রকাশ না পায়, সেই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা জরুরী।\”
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
১। একটা লেখা পড়ে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালো লেগেছে। তাই শেয়ার দেয়ার জন্যে এই পোস্ট।
২। এতক্ষন যা পড়লেন তার ইনভার্টেড কমা [\” \”] এর ভেতরের অংশটুকু মূল লেখকের।
বাকিটুকু আমার।
৩। মূল লেখা:
http://www.sachalayatan.com/sobjanta/54709?fb_action_ids=10206983600893090&fb_action_types=og.likes&fb_ref=.VZvhLt2rZ1I.like&fb_source=other_multiline&action_object_map=%5B856295674457419%5D&action_type_map=%5B%22og.likes%22%5D&action_ref_map=%5B%22.VZvhLt2rZ1I.like%22%5D