পাগলের সুখ মনে মনে : ৪

ছোট থাকতে আম্মাকে প্রায়ই একটা কথা বলতাম।
\”আম্মা\”, বলে এক সেকেন্ড গ্যাপ।
\”আম্মাগো\”, বলে আরেকটু বড় গ্যাপ।
এরপর আম্মার দিকে তাকিয়ে, \”ভাল্লাগেনা\”।

\”আম্মা, আম্মাগো,  ভাল্লাগেনা।\”

এই কথাটা বলতে বলতে এমন শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেসিলাম যে আম্মা আমাকে ভ্যাঙানো শুরু করে দিসিলো।
আমি যখনই বলতাম, \”আম্মা, আম্মাগো,\” বলে বাকিটা বলার জন্যে  আম্মার দিকে তাকাতাম, তখনই আম্মা আমাকে শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠত, \”ভাল্লাগেনা।\”
বলেই একট ডাইনীমার্কা হাসি দিত।
শেষে আমি বিরক্ত হয়ে টোন পাল্টালাম –
\”আম্মা, আম্মাগো, খুব ভাল্লাগতাসে।\”

কাছের মানুষজনকে কষ্ট দিয়ে না একধরনের আনন্দ হয়, কেমন কেমন যেন ওই আনন্দটা।
বুক ফেটে কান্না আসে, তারপরও খুব খুশি খুশি লাগে।নিজেকে খুব জয়ী জয়ী মনে হয়।ঠিক যেন বুকে পাথর চাপিয়ে মুখে হাসি ফুটানো।

আজকে খুব খেতে মন চাইলো।অনেক কিছু-

গরম ভাত, এত গরম যে হাত লেগে গেলে কানের লতিতে আংগুল ছোয়াতে হবে।সেই সাথে হালকা ভেজা।

করলা ভাজি।বেশি তেল দেয়া।বেশি পেয়াজ দেয়া।এমন হতে হবে যেন করলার তিতা ভাবটা না থাকে।

আলুভর্তা, পোড়া মরিচ দিয়ে।আলুভর্তার আলুটা ডালের সাথে সিদ্ধ করা হতে হবে।
বেশি ঝাঝ ওয়ালা সরিষার তেল দিয়ে মাখানো থাকবে।

ডাইল।স্পেকস জানি না।আম্মা রান্না করে।গরম হতে হবে।\’ডাল\’ আর \’ডাইল\’ এত মধ্যে খুব সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে।

কড়া করে ডিমভাজি।কাচা মরিচ, পেয়াজ দিয়ে।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে বুধবার রাতে একটা মিষ্টি খাওয়াইত।ছোট সাইজের মিষ্টি।ওইগুলা একটা।

বুমার্স এ ম্যাংগো জুস খাইসিলাম ইফতারে।ঐটা।

গোমতীর পাড়ে,বাবুর বাজার নামের একটা বাজার আছে।ওই বাজারে ২০০৫ সালের দিকে একটা দোকান ছিলো।চায়ের দোকান,এখন নাই এইটা।এই দোকানের চা।

নীলক্ষেত বইয়ের দোকানগুলার সামনে এক মামা পেয়ারার সাথে কাসুন্দি মিশায়ে বিক্রি করতো,নামটা ভুলে গেসি।ওইটা।

জিলা স্কুলের ক্যান্টিনে আগে একটা পিজা বানাইতো,১০ টাকা দাম।মারাত্মক ঝাল। ওইটা।

হাফ লিটার ঠান্ডা মিরিন্ডা আর ২৫০ মিলি ঠান্ডা ফ্রুটো একটা গ্লাসে নিয়ে তিনবার এন্টিক্লকওয়াইজ ঘুরায়ে বানানো ড্রিংক্স।আমি এটারে বলি ককটেল।

আম্মাকে বললে কালকেই রান্না করে খাওয়াবে। কিংবা হয়ত আজকেই।
কিন্তু আম্মা খাওয়ালে হবে না।আমি চাই
কেউ আমাকে সারপ্রাইজ দিক।বিশেষ কেউ।

ও এসে বলবে, \”আজকে রান্না দিবস।কি কি খাবা বল।যা বলবা সব রান্না করে খাওয়াবো আজকে।\”
আমি একটার পর একটা বলে যাব।
ও অনেক সময় ধরে রান্না করবে।রান্না শেষে ঘেমে নেয়ে একাকার হবে।আমি ওকে ফ্রেশ হতে পাঠাবো।ও হাতমুখ ধুতে যাবে।
আমি ওই ফাকে দৌড় দিব।পেস্ট্রি শপে।
পেস্ট্রির উপরে লিখবো,
\”সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন\”।

এসে আমি ওয়াশরুমের পাশের দরজার আড়ালে লুকাব।ও বের হয়ে আমাকে খুজবে।আমি চোখ দুটো পেছন থেকে ধরবো।তারপর হাত ধরে নিয়ে যাবো ডাইনিং এ।পেস্ট্রির বক্স দেখে ওর চোখের কোনে হাসি ফুটবে।অদ্ভুত সে হাসি, চোখে আছে কিন্তু মুখে নেই।
কেকের উপরের লেখা দেখে ও হেসে কুটিকুটি হবে।
\”এই পাগল এইটা কি লিখসো?\”
– সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন।
\”এইটা কেন লিখসো?\”
-এমনি।
\”এমনি মানে?\”
-এমনি মানে এমনি।
\”তুমি পচা একটা।কিচ্ছু জানোনা।\”
-…….

আমরা দুজনে মিলে কেক কাটবো।
আমি ওকে খাওয়াবো।
ও যখন আমাকে খাওয়াতে আসবে তখন আমি হুট করে ওর কপালে  চুমো দিব।
একটা।
দুইটা।
তিনটা।
পরপর তিনটা চুমো।
হ্যাটট্রিক।
এরপর হাত দিয়ে কপালের সামনে এসে পড়া চুল সরায়ে দিব।
সরায়ে চোখের দিকে তাকাবো।
তাকিয়েই থাকবো।
তাকিয়েই থাকবো।
তাকিয়েই থাকবো।

ওর চোখের কোন ভিজে উঠবে।
আমি বলবো,\”ওমা কাঁদে কেন?\”
ও হয়ত মাধবীলতার মত বলবে, \”তোমার ওসব বুঝতে হবে না।তুমি শুধু এমনি করে ভালোবেসো।\”

উফফ,বড্ড বেশি ভেবে ফেলেছি,তাইনা? বুকের ভেতর ব্যাথা হচ্ছে।
ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠছে,
\”আম্মা, আম্মাগো, খুব ভাল্লাগতেসে।\”

Tags:

0 thoughts on “পাগলের সুখ মনে মনে : ৪”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top